জোনাকজ্বলা রাতে উঠোনে মাদুর পেতে শুয়ে থাকতাম। দাদি-নানির মুখে তাদের মা-দাদি-নানির সংসার করার গল্প শুনতাম। সে সময় নারীদের বিবাহিত জীবন খুব কষ্টের ছিল। তাদের জোরে কথা বলা যেত না। দিনে স্বামী-স্ত্রীর মুখ দেখাদেখিতেও ছিল বিধিনিষেধ। আপাদমস্তক ছিল একটা নির্দিষ্ট রুটিনবাঁধা জীবন। মূলত নারীর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ছিল পরিবার কর্তৃক অধীনে থাকার বাধ্যবাধকতা।
আবহমানকালের প্রচলিত প্রবাদ হলো, ‘মেয়েদের রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘর’— এ দুটোতেই তাদের মানায়। তাই ছোটবেলা থেকেই সেই অনুযায়ী মেয়েদের তৈরি করা হতো। রান্নাবান্না, সেলাই-ফোঁড় আর গৃহস্হালি কাজের উপযোগী করে গড়ে তুলত। মূলত তখনকার সমাজব্যবস্হা জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে তুলত। ফলে তাদের স্বতন্ত্র সত্তা বলে সমাজে স্বীকৃত ছিল না। বড় হয়ে বুঝলাম, সম্প্রতি অতীতের আঁধারের ঘোর কেটে গেলেও এর অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান। যদিও অতীতে নারীর বুকের খোঁড়লে ছিল কেবলই দীর্ঘশ্বাসের মরুঝড়! আজ সেখানে কোথাও কোথাও শুনতে পাই বৃষ্টিপাতের রিমঝিম শব্দ। নারীরা আজ প্রগতিবিরুদ্ধ গণ্ডি অতিক্রম করছে।
তথাপি সমাজে নারীরা মানুষ হিসেবে এখনো মর্যাদা পায়নি। নারীদের একদিকে যেমন আছে সংগ্রামের চিত্র, অন্যদিকে আছে সহস্র বঞ্চনা-নিগ্রহের চিত্র। গতানুগতিকভাবে একজন নারী স্ত্রী, কন্যা, বোন ও সর্বোপরি ‘মা’রূপেই পরিচিত। তবু নারীরা যথার্থ অর্থেই এখনো শৃঙ্খলিত। এই শৃঙ্খলা মূলত পরিবার কর্তৃক সৃষ্ট। পরিবারই সৃষ্টি করে নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ এবং পারিবারিক মূল্যবোধ। এ যেন শাঁখের করাত।
মূলত পারিবারিক কত রকমের অনাচার যে এ দেশের নারীরা সহ্য করে জীবন ধারণ করছে, তার ইয়ত্তা নাই। নারী চরিত্রের অকলুষতা প্রমাণের জন্য সমাজ কর্তৃক আচরণবিধি তৈরি হয়। সে অনুযায়ী এখন ভালো মেয়ের সংজ্ঞা হচ্ছে, আঁচল বা ওড়নায় মাথা ঢেকে চলাফেরা করা। কর্মস্হলে, বাইরে, হাটে বা কোথাও খোলামেলাভাবে না যাওয়া। যত্রতত্র পুরুষদের সঙ্গে কথা না বলা। ধরে নিচ্ছি, নির্বিঘ্নে চলাফেরায় এগুলো একটা অনুকূল স্বাচ্ছন্দ্য আনে। তার পরেও কী মেয়েদের নিষ্কৃতি মেলে? রাস্তাঘাটে সম্ভমহানি ও নিগৃহীত হওয়ার দায় কিন্তু মেয়েদের ঘাড়েই চাপে।
তাছাড়া স্কুলগামী মেয়েদের রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করার মতো সাধারণ ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিচার চাইতে গেলেই সংকট বাড়ে। তাই লাঞ্ছনা আর অপহরণ থেকে বাঁচাতে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হন অভিভাবকরা। এতে মেয়েটির না হয় শিক্ষা, না হয় কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন। তাছাড়া এ বয়সে মেয়েরা কীই-বা অর্জন করতে পারে? তাই মেয়েদের গুণাবলি যত কম যৌতুকের দাবি তত বেশি। যৌতুকের জন্য খুন হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তাই যৌতুকে দিয়ে মেয়ের সুখ কেনেন বাবারা। যৌতুকই যেন সুখের চাবিকাঠি। তবু সুখের নাগাল পায় না তারা। শেষমেশ অসহায় বাবার করুণ আকুতি, ‘মানিয়ে চল রে মা! ধরে নে, এটাই নারীদের নিয়তি। সহ্য করে মাটি কামড়ে পড়ে থাক স্বামীর বাড়িতে।’
সম্প্রতি পত্রিকার পাতা খুললেই নারী নির্যাতনের রগরগে খবর চোখে পড়ে। যৌন নির্যাতন আর ধর্ষণ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের ৮৫ শতাংশই কন্যাশিশু। এটা এখন আর সমাজে মুখরোচক আলোচনার ব্যতিরেক কিছুই নয়। মিডিয়ার সদয় সুবাদে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসে বলে আমরা জানি। আসলে এমন কতশত ঘটনা চাপা পড়ে যায়। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে কিশোরী মেয়েরা ধর্ষণ শব্দটির সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার আগে ধর্ষিত হয়। ওরা মাকে জানালে অমনি মা মুখ ঠেসে ধরেন। বলেন, ‘চুপ কর পোড়াকপালি! কাউকে বলবি না।’ জানাজানি হলে বিচার সালিসি! দেনদরবার কিংবা মামলা-মোকদ্দমা, আরো কত কী? হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি তো থাকছেই। উপরন্তু ‘ধর্ষিতা’— এই অমোচনীয় তকমা বয়ে বেড়াতে হয় আমৃতু্য। ধর্ষিতা মেয়েকে সমাজও ভালো চোখে দেখে না। তাই গোপন রাখাটাই শ্রেয় মনে করে তারা। অথচ এত বড় নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজ থেকে তাদের কোনো দ্রোহ নেই। এই যেন প্রকারান্তরে নির্যাতনকেই মেনে নেওয়া। এক্ষেত্রে ফরাসি দার্শনিক সিমন দ্য বোভায়ারের কথাগুলো প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নারীও বিচার করে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। নিজের চোখে পৃথিবীকে দেখতে তারা অভ্যস্ত হতে পারছে না।’ আবার কখনো নারীও পুরুষের সঙ্গে তাল মেলায়। ফলে নারী নিজে নির্যাতিত হয়েও অন্য নারীদের নির্যাতনে ইন্ধন জোগায়। তাই তো নারীঘটিত হত্যা, নির্যাতনের মূলে আছে শাশুড়ি-ননদের বা স্বামীর পরিবারের অন্য কারো প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন মদদ।
বেগম রোকেয়া যথার্থ অর্থেই নারীকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘অবরোধবাসিনী’ বলে। অবরোধ মানেই দমন। জীবনযাপনের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এই অবরোধটা তৈরি হয় বিশেষভাবে দেওয়াল তৈরি করে নয়। অবরোধের দেওয়াল হলো নারীর ওপর পরিবারের কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এতে আর যা-ই হোক, সংসারে সুখ বয়ে আনে না।
নারী-পুরুষ মূলত সমাজের দুটো চক্ষুস্বরূপ। মানুষের যেমন সব রকমের কাজকর্মের প্রয়োজনে দুটো চক্ষুর গুরুত্ব সমান, তেমনি সমাজসংস্কারে, রাষ্ট্রের উন্নয়নেও নারী-পুরুষের সমান গুরুত্ব রয়েছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।